দাঁড়াশ সাপ। বিষধর নাকি নির্বিষ ?
দাঁড়াশ সাপের কামড়ে কি মানুষ মারা যায় ? দাঁড়াশ সাপের লেজে কি বিষ থাকে ?
দাঁড়াশ সাপ
আজকে প্রথম বারের মত লিখতে চলেছি দাঁড়াশ সাপ নিয়ে। যেহেতু আমাদের দেশে এই সাপের বেশ আনাগোনা দেখা যায় এবং মারাত্মক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন তাই এই সাপ নিয়ে আমার আজকের লিখা। টপিক দাঁড়াশ। ছবিতে আপনারা যে সাপটি দেখতে পাচ্ছেন তার নাম দাঁড়াশ। বর্ষাকালে এই সাপের বেশ আনাগোনা দেখা যায় তবে অনেক সময় দেহকে উষ্ণ কিংবা গরমকালে ঠান্ডা রাখতে এরা মানুষের বাসায় ঢুকে পড়ে।
সাপটির অপর নাম বলা চলে কৃষকের বন্ধু। কি অবাক হলেন?? সাপ আবার কিভাবে কৃষকের বন্ধু হয় তাই না?
একটু বুঝিয়ে বললেই বুঝতে পারবেন।
তদরূপ গতকাল প্রচুর বৃষ্টিতে বাইরের আবহাওয়া খুবই ঠান্ডা ছিলো আর আমাদের বাসায় ঢুকে পড়ে একটি মাঝারি সাইজের দাঁড়াশ এবং ফ্রিজের পেছনে লুকিয়ে পড়ে। বাসার মানুষের চেচামেচিতে সাপটি বেশ ভয় পেয়ে তার অবস্থানে আরো জোড়ালো হয়। ফ্রিজের পেছনের যায়গাটি অনেকটা সরু হওয়ার এটিকে কোনভাবেই বের করা সম্ভব হচ্ছিলো না। দীর্ঘক্ষণ সময় অপেক্ষার পরে একটি লাঠির সাহায্য এটিকে বের করে আনতে সক্ষম হই।
বরাবরের মতই বার বার পেছন থেকে আওয়াজ আসছিলো এটিকে যেনো মেরে ফেলা হয়। তবে আমি বেঁচে থাকতে কি আর সাপ মারতে দেওয়া যায়। প্রায় ২০ মিনিট চেষ্টার পর সাপটি ধরতে সক্ষম হই এবং পরে পাশেই একটি জলাবদ্ধত জমিতে ছেড়ে দেই।
নাম Ptyas mu দাঁড়াশের ইংরেজি নাম Rat Snake এবং বৈজ্ঞানিক cosa।
সাপটি প্রাপ্ত বয়স্ক হলে প্রায় 350 সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।
আমরা সবাই জানি, ইঁদুরের ইংরেজি নাম Rat এবং দাঁড়াশের প্রধান এবং প্রিয় খাবার ইঁদুর তাই সে অনুযায়ী দাঁড়াশের ইংরেজি নামকরণ করা হয়েছে Rat Sanke।
দাঁড়াশ সাপ সম্পুর্ন নির্বিষ।
দাঁড়াশ সাপ মূলত ফসলের জমিতে থাকতে পছন্দ করে এবং তার আশে পাশে প্রায় ৩ একর এলাকা সে বিচরণ করে এবং এই জায়গায় খুঁজে খুঁজে ইঁদুর শিকার করে যার ফলে ইঁদুরের কারণে যে ফসল হানী ঘটে তা থেকে রক্ষা মিলে।
আগেই বলেছি কৃষকের নীরব বন্ধু নির্বিষ সাপ দাঁড়াশের প্রধান খাবার ইঁদুর। মূলত ইঁদুর খেয়েই সে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি কৃষকের বন্ধু হিসেবে কাজ করে। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, প্রতি বছর ইঁদুর যে পরিমাণ খাদ্যশস্য নষ্ট করে তার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয় ধান ও গমের।
আর এই ক্ষতি ঠেকাতে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে দাঁড়াশ। তবে অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের কারণে এই বন্ধু কৃষকের হাতেই প্রতিনিয়ত মারা পড়ছে উপকারী দাঁড়াশ সাপ। ভেবে দেখুন ইঁদুর নিয়ন্ত্রণের জন্য দাঁড়াশ সাপটি যেহেতু প্রাকৃতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তাই এই সাপকে রক্ষা করতে পারলে বছরে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকার ফসলের পাশাপাশি কৃষি বিভাগ যে টাকা ইঁদুর নিধনে খরচ করে সে টাকাও রক্ষা করা সম্ভব।
আসলে সবকিছু মেন্টালিটির একটি ব্যাপার। ছোটবেলা থেকেই আমাদের সকল সাপকে অনেক ভয়ানক রূপে দেখা হয়, আমাদের মাইন্ড সেটাপও ওভাবে তৈরি হয়। সাপ দেখলেই যেন ওটাকে মারতেই হবে এবং মারার জন্য প্রতিযোগিতার ধুম পড়ে। আমরা মনে করি জলঢোড়া বাদে সব সাপই বিষধর। তাছাড়া সাপের খেলা দেখানো বেঁদেরা অনর্থক / বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনি বলে মানুষের মনে ভীতির সৃষ্টি করে। আজে-বাজে তাবিজ-কবচের কথা বলে গ্রামের মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়।
আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে দাঁড়াশ সাপ দেখতে অনেকটা বড় এবং কোবরার মত দেখতে, তাই মানুষ না জেনেই একে বিষধর ভাবে। তবে এই দুটির মধ্যে অনেক লক্ষ্যনীয় বিষয় রয়েছে। প্রধানত কোবরা ফনা তুলে আর দাঁড়াশের ফনা নেই।
এবার আসি কিছু মজার বিষয়ে। সাপ নিয়ে আমাদের দেশে প্রচুর মিথ্যা কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে। যদিও বিজ্ঞান অনেকটা দূর এগিয়ে গিয়েছে ততখানি গ্রামের কুসংস্কার কাটিয়ে উঠেনি। যদি দাঁড়াশের উদাহরণ দিয়ে বলি, গ্রাম্য মানুষের ধারনা দাঁড়াশ সাপের ফনা না থাকলেও কোমরে বা লেজে কাঁটা আছে। দাঁড়াশ সাপে কাটলে মানুষ তাতক্ষনাৎ মারা যায়, লেজ দ্বারা আঘাত করলে আঘাত প্রাপ্ত অংশ পঁচে যায়, হত্যার প্রতিশোধে অপর সাপ রাতে ছুটে আসে। কি সব অদ্ভুত কাল্পনিক সব কথা, ইভেন আমি লিখছি আর হাসছি।
এই সাপটি ধরার পরেও বুঝাতে ব্যার্থ হয়েছি দাঁড়াশের ছোবলে মানুষ মারা যায় না এবং দাঁড়াশ সাপ রাতে গাভী থেকে দুধ চুষে খেয়ে থাকে না। এগুলো সবই ভুল ধারনা। দাঁড়াশ সাপের কোমর বা লেজ বা শরীরের কোথাও এমন কোনো কাঁটা নেই।
বাস্তবে সাপটি খুব নিরীহ তবে রেগে গেলে বা ভয় পেয়েও যদি কাউকে কামড় দেয় তবু কিচ্ছু হবেনা কারণ এটি নির্বিষ সাপ।বাংলাদেশে ৮০টি প্রজাতির সাপ রয়েছে। এদের মধ্যে ৮০ শতাংশ নির্বিষ এবং বাকি ২০ শতাংশ বিষধর। তাই উপরোক্ত পোস্ট পড়ে অতি উৎসাহী হয়ে সাপ ধরতে যাবেন না।
আর অবশ্যই বিষধর সাপে কাটলে ওঝার কাছে না গিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবেন। কেউ ওঝা দেখানোর পরামর্শ দিলে তার মাথা ফাটিয়ে তাকেও সাথে করে ডাক্তারের নিকট নিয়ে যাবেন।
আমাদের দেশে যে সমস্ত বিষধর সাপ রয়েছে, হাসপাতালে তার প্রায় সবগুলোরই এন্টিভেনম পাওয়া যায়। তাই বিষধর সাপে কাটলে প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে অতিদ্রুত হাসপাতালে যোগাযোগ করুন এবং দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠোন।
ধন্যবাদ।
Farhad Asif